ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী [পর্ব ১]

যারা সত্যিই একটি ইসলামী সমাজ কায়েম করতে চান তাদের 

সর্বপ্রথম ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে, আমাদের জাতির মধ্যে একটি আদর্শ ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খার মোটেই অভাব নেই। আসল অভাব আগ্রহ ও উদ্যোগ গ্রহণের এবং তার চাইতে বেশী অভাব যোগ্যতার। এ কাজের জন্য যে মৌলিক গুণাবলীর প্রয়োজন অধিকাংশ লোকের মধ্যে তা অনুপস্থিত।


দ্বিতীয় যে বিষটির প্রতি তীক্ষ নজর রাখতে হবে তা হচ্ছে আমাদের জাতির সমগ্র প্রভাবশালী অংশ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজে বিকৃতি ও ভাঙ্গন সৃষ্টিতে মুখর। আর যারা বিকৃতি ও ভাঙ্গনের কাজে লিপ্ত নেই তারাও সৃষ্টি ও বিন্যাসের চিন্তামুক্ত। সমাজ সংস্কার ও গঠনের প্রচেষ্টারত ব্যক্তিদের সংখ্যা মুষ্টিমেয়। 


তৃতীয় যে বিষয়টি থেকে উচিৎ নয় সেটি হচ্ছে, বর্তমান যুগে সমাজ জীবন পরিগঠণ ও ভাঙ্গার বৃহত্তম শক্তি হচ্ছে সরকার। আর যেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকে সেখানে জনগনের উপযুক্ততা বা অনুপযুক্ততা ব্যক্তিদের হাতে শাসন ক্ষমতা সোপর্দ করার ওপরই সরকারের উপযুক্ত বা অনুপযুক্ত পূর্ণতঃ নির্ভরশীল। ভাঙ্গার কাজে যারা লিপ্ত থাকে তারা জনগণ যাতে কোনদিন নির্ভুল নির্বাচনের যোগ্য না হতে পারে সেজন্যে জনগণকে প্ররোচিত করার কাজে যতো শক্তি ব্যয় করে অন্য কাজে ততো ব্যয় করে না।




এ তিনটি বিষয়ের সমন্বয়ে একটি ভয়াবহ দৃশ্য সৃষ্টি করে যা প্রথমাবস্থায় মানুষের মনে নিরুৎসাহের সঞ্চার করে এবং চারদিকের নৈরাশ্যের মধ্যে সে চিন্তা করতে থাকে, এখানে কোন কাজে সফলতা কি সম্ভব? কিন্তু এগুলোর বিপরীতে আরো কতিপয় বিষয় রয়েছে যেগুলো সামনে রাখলে নিরাশার মেঘ কেটে যেতে থাকে এবং আশার আলোকচ্ছটায় চতুর্দিক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।


  • প্রথমটি হচ্ছে আমাদের সমাজ কেবল অসৎ লোকের আবাসস্থল নয়, এখানে কিছু সংখ্যক সৎলোকও আছে। তারা কেবল সংশোধন ও চরিত্র গঠনের আকাঙ্খা মনে পোষণ করে না, বরং তাদের মধ্যে আগ্রহ ও যোগ্যতা রয়েছে। আর এর মধ্যে কিছুটা অভাব থাকলেও সামান্য যত্ম ও প্রচেষ্টায় তা পরিবর্ধিত করা যেতে পারে।


  • দ্বিতীয় হচ্ছে, আমাদের জাতি সামগ্রিকভাবে অসৎপ্রবণ নয়। অশিক্ষা ও অজ্ঞতার দরুন তারা প্রতারিত হতে পারে এবং প্রতারিত হয়ে আসছে, কিন্তু প্রতারণাকারীরা যে বিকৃতির সম্মুখীন করে তার ওপর তারা সন্তুষ্ট নয়। বিচক্ষনতার সাথে সুসংবদ্ধ ও অবিরাম প্রচেষ্টা চালালে দেশের জনমতকে অবশেষে সংশোধন প্রয়াসী শক্তিগুলোর সমর্থকে পরিণত করা যেতে পারে। সমাজে অসৎ শক্তিগুলোর প্রভাবের ফলে যে সমস্ত অনাচারের সৃষ্টি হচ্ছে জাতির বৃহত্তম অংশ খোদ তার পরিপোষক হলে অবশ্যি নিরাশার কথা ছিল। কিন্তু আসল পরিস্থিতি তা নয়।


  • তৃতীয় কথা হচ্ছে, বিকৃতির জন্য কাজ করে যাচ্ছে তারা সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা লাভ করেছে কিন্তু দু’টি সুবিধা অর্জন করতে পারেনি। একঃ চারিত্রিক শক্তি, দুইঃ ঐক্যের শক্তি।


  • সর্বশেষ ও সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ আল্লাহ তায়ালার নিজের কাজ। এজন্য যারা প্রচেষ্টা চালায় তারা আল্লাহর সমর্থন লাভ করে তবে শর্ত হচ্ছে এই যে, তাদের সবর ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে হবে। বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা পরিহার করলে চলবে না। এ ধরণের লোক যতই স্বল্প সংখ্যক হোক না কেন এবং তাদের সাজ-সরঞ্জাম-উপকরণাদি যতই সামান্য হোক না কেন অবশেষে আল্লাহর সাহায্য ও সমর্থন তাদের সকল অভাব পূরণ করে দেয়।


আপাতঃ নৈরাশ্যের পেছনে আশার এ আলোকচ্ছটা একটি আদর্শ ইসলামী সমাজের কেবল সম্ভাবনার উন্মেষ সাধনই নয় বরং তার সফল প্রতিষ্ঠারও দিগন্ত উন্মুক্ত করে। তবে প্রয়োজন হচ্ছে, যারা এ কাজের সত্যিকার আকাঙ্খা পোষণ করে তাদের আশা ও আকাঙ্খার মন্জিল অতিক্রম করে কিছু করার জন্য অগ্রসর হতে হবে এবং সাফল্যের জন্য আল্লাহ যে নীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন সেই পদ্ধতিতে এগিয়ে যেতে হবে। আপনি কেবল অসৎ কাজ ও দোষত্রুটির সমালোচনা করে যাবেন এবং সেগুলো নিছক আপনার কথার জোরে শুধরে যাবে, এটা আল্লাহর নীতি নয়। আপনি হাত ও পায়ের শক্তি ব্যবহার না করা পর্যন্ত জংগলের একটি কাঁটা এবং পথের একটি পাথরও সরে না। তাহলে সমাজের দীর্ঘকালের দোষত্রুটিগুলো নিছক আপনার কথার জোরেই বা কেমন করে দূর হতে পারে? কৃষকের পরিশ্রম ছাড়া ধানের একটি শীষও উৎপন্ন হয় না। তাহলে নিছক দোয়া ও আশার মাধ্যমে কেমন করে সমাজে সততা ও সৎপ্রবণতার সবুজ শ্যামল শস্য উৎপাদনের আশা করা যেতে পারে? যখন আমরা ময়দানে নেমে কাজ করি এবং আল্লাহর নিকট সাফল্যের দোয়া চাই তখনই সমালোচনা কার্যকরী হয়। নিঃসন্দেহে ফিরিশতাদের আগমন ঘটে। কিন্তু তারা নিজেরা লড়বার জন্য আসে না। বরং যে সকল সত্যপন্থী খোদার পথে প্রাণ উৎসর্গ করার জন্য লড়াই করতে থাকে তাদেরকে সাহায্য করতে আসে। 

কাজেই যাদের মনে কাজ করার আগ্রহ আছে তাদের মিথ্যা আশা-আকাঙ্খার পথ পরিহার করে সুস্থ মস্তিষ্কে এ কাজের যাবতীয় দাবী ও চাহিদা উপলব্ধি করা উচিৎ। অতঃপর তারা কি সত্যিই এ কাজ করবেন, না নিছক সমাজের বিকৃতি দেখে অশ্রুপাত করবেন এবং সমাজ গঠনের আকাঙ্খা হৃদয়ে পোষণ করেই ক্ষান্ত হবেন, এ ব্যাপারে যথার্থ চিন্তাভাবনা করে তাদের সিদ্ধান্ত করা উচিৎ। কাজ করার সিদ্ধান্ত যিনি করবেন তিনি উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে নয় বরং সুস্থ মস্তিষ্কে ভেবে চিন্তেই করবেন। সাময়িক উত্তেজনার বশে মানুষ বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিতে এবং প্রাণ দান করতে পারে কিন্তু সাময়িক উত্তেজনার বশে একটি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে পৌছার জন্য সারা জীবন পরিশ্রম করা তো দূরের কথা মাত্র চারদিন কোন অসৎ কাজ থেকে দূরে থাকা অথবা কোন সৎ কাজের উপর অটল থাকা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। যারা সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নিজেদের সমগ্র জীবন গঠনমূলক ভাবে নিয়োগ করতে প্রস্তুত হয় একমাত্র তারাই এ কাজ করতে পারে।


কাজ করার আগ্রহ ও উদ্দেশ্য গ্রহণের সাথে সাথে মানুষ সাধারণতঃ কর্মসূচীর প্রশ্ন উত্থাপন করে। কিন্তু তারা ভুলে যায়, কর্মের সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচীর মধ্যবর্তী স্থানে কর্মীর নিজের সত্তাই হচ্ছে কাজের আসল ভিত্তি ও নির্ভর। এ বিষয়টিকে বাদ দিয়ে কাজ ও কর্মসূচীর কথা বলা ঠিক নয়। কাজ করার জন্য কেবল সংকল্পই যথেষ্ট এবং এরপর শুধুমাত্র কর্মসূচীর প্রশ্ন থেকে যায়, এ কথা মনে করা ভুল। এ ভুল ধারণার কারণে আমাদের এখানে অনেক বড় বড় কাজ শুরু হয়েছে এবং পরে তা চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই কর্মসূচী ও পরিকল্পনা আসল নয়, আসল হচ্ছে এগুলোর বাস্তবায়নে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ ও তাদের চারিত্রিক গুণাবলী এবং প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক গুণাবলী। কর্মসূচী ও পরিকল্পনার সাফল্য ও ব্যর্থতার মূলে এটিই আসল কার্যকর শক্তি। ব্যক্তির প্রতিটি দুর্বলতা কাজের ফলাফলকে প্রভাবিত করে এবং তার প্রতিটি গুণ কাজকে সুষমা-মন্ডিত করে। সে উন্নত ও উত্তম গুণাবলীর অধিকারী হলে একটি ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনা ও বাজে কর্মসূচীকেও এমন সফল পরিচালনার মাধ্যমে চূড়ান্ত লক্ষে উন্নীত করে যে মানুষ অবাক হয়ে যায়। বিপরীতপক্ষে তার যোগ্যতার অভাব থাকলে উত্তম কাজও পণ্ড হয়ে যায়। এমনকি অযোগ্য লোক যে কাজ সম্পাদনে ব্রতী হয় তার নির্ভুলতা সম্পর্কেও মানুষের মনে সন্দেহ জাগে। কাজেই সংস্কার ও গঠনমূলক বাস্তব পরিকল্পনা সম্পর্কে চিন্তা করার আগে এ কাজ সাধনের জন্য যে সব লোক এগিয়ে আসবে তাদের কোন্ ধরনের যোগ্যতা থাকতে হবে, কোন্ ধরণের গুণাবলী সমন্বিত হতে হবে এবং কোন ধরণের দোষ ত্রুটি থেকে তাদেরকে মুক্ত হতে হবে, উপরন্তু এ ধরণের লোক গঠনের উপায়-পদ্ধতি কি, এ ব্যাপারেও যথাযথ পর্যালোচনা করতে হবে।
পরবর্তী আলোচনায় এ বিষয়টিকে আমরা নিন্মোক্ত ক্রমানুসারে বর্ণনা করবোঃ




১) এ উদ্দেশ্যে যারা কাজ করে তাদের প্রত্যেকের মধ্যে ব্যক্তিগত যেসব গুণ থাকা উচিৎ।
২) তাদের মধ্যে সামষ্টিক পর্যায়ে যেসব গুণ থাকা উচিৎ।
৩) ইসলাম প্রচার, ইসলামী দাওয়াত সম্প্রসারণ ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সাফল্য অর্জনের জন্যে যেসব গুণ থাকা উচিৎ।
৪) ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে যেসব বড় বড় দোষ ত্রুটি থেকে তাদের মুক্ত থাকা উচিৎ।
৫) অভিপ্রেত গুণাবলীর বিকাশ সাধনে ও অনভিপ্রেত গুণাবলী থেকে ব্যক্তি ও সমষ্টিকে মুক্ত রাখার জন্যে যেসব উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে।




দুনিয়ায় ইসলামী জীবন ব্যবস্থা বাস্তবে প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর সাহায়্যের পর সাফল্যের দ্বিতীয় চাবিকাঠি হচ্ছে এ কাজ সম্পাদনের জন্যে প্রচেষ্টরত ব্যক্তিবর্গেও নিজস্ব গুণাবলী। কতিপয় গুণাবলী ব্যক্তিগতভাবে তাদের প্রত্যেকের মধ্যে থাকতে হবে। কতিপয় গুণাবলী সমষ্টিক পর্যায়ে তাদের মধ্যে থাকা প্রয়োজন। কতিপয় গুণাবলীর সংস্কার ও গঠনমূলক কার্য সম্প্রসারণের জন্যে তাদের মধ্যে থাকতে হবে। আবার কতিপয় দোষত্রুটি থেকে যদি তারা নিজেদেরকে মুক্ত না রাখে তাহলে তাদের সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। সবার আগে এ বিষয়গুলো অনুধাবন করতে হবে। ফলে যারা এ খেদমতের সত্যিকার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ তারা নিজেদের অনভিপ্রেত গুণাবলীর লালন ও অনভিপ্রেত গুণাবলী থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখার জন্য বিশেষভাবে সচেষ্ট হতে পারবে। সমাজ গঠনের জন্য এভাবে ব্যক্তি গঠন হচ্ছে প্রথম শর্ত। কারণ যে নিজেকে সজ্জিত ও বিন্যস্ত করতে পারে না সে অন্যকে সজ্জিত ও বিন্যস্ত করার ব্যাপারে কিছুই করতে পারে না।


১) ব্যক্তিগত গুণাবলী

ইসলামের যথার্থ জ্ঞানঃ

ব্যক্তিগত গুণাবলীর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ইসলামের যথার্থ জ্ঞান। যে ব্যক্তি ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কায়েম করতে চায় তাকে সর্বপ্রথম যে জিনিসটি কায়েম করতে চায় তা জানতে ও বুঝতে হবে। এ কাজের জন্য ইসলামের নিছক সংক্ষিপ্ত জ্ঞান যথেষ্ট নয় বরং কমবেশী বিস্তারিত জ্ঞানের প্রয়োজন। আর এর স্বল্পতা ও বিপুলতা মানুষের যোগ্যতার উপর নির্ভরশীল। এ জন্যে এ পথের প্রত্যেকটি পথিককে এবং আন্দোলনের প্রত্যেকটি কর্মীকে মুফতি বা মুজতাহিদ হতে হবে এমন কোনো কথা নেই তবে তাদের প্রত্যেককে অবশ্যি ইসলামের আকীদা বিশ্বাসকে জাহেলী চিন্তা কল্পনা ও ইসলামী কর্মপদ্ধতিকে জাহেলিয়াতের নীতি-পদ্ধতি থেকে আলাদা করে জানতে হবে এবং জীবনের বিভিন্ন বিভাগে ইসলাম মানুষকে কি পথ দেখিয়েছে সে সম্পর্কে অবগত হতে হবে। এ জ্ঞান ও অবগতি ছাড়া মানুষ নিজে সঠিক পথে চলতে পারে না, অন্যকেও পথ দেখাতে পারে না এবং সমাজ পরিগঠনের জন্যে যথার্থ পথে কোন কাজ করতেও সক্ষম হয় না। সাধারণ কর্মীদের মধ্যে এ জ্ঞান এমন পর্যায়ে থাকতে হবে যার ফলে তারা গ্রাম ও শহরের লোকদেরকে সহজ-সোজাভাবে দ্বীনের কথা বুঝাতে সক্ষম হবে। কিন্তু উন্নত বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী কর্মীদের মধ্যে এ জ্ঞান অধিক মাত্রায় থাকতে হবে। তাদের বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে হবে। শিতি লোকদের সকল প্রকার সন্দেহ-সংশয় নিরসন করতে হবে। বিরুদ্ধবাদীদের প্রশ্নের যুক্তিপূর্ণ ও সন্তোষজনক জবাব দিতে হবে। ইসলামের আলোকে জীবনের বিভিন্ন সমস্যাবলীর সমাধান করতে হবে। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষা ও শিল্পকে নতুন ছাঁচে ঢালাই করে বিন্যস্ত করতে হবে। ইসলামের অনাদী ও চিরন্তন ভিত্তির ওপর একটি নতুন সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রাসাদ গড়ে তুলতে হবে। আধুনিক চিন্তা ও কর্মের ত্রুটিপূর্ণ অংশকে ত্রুটিহীন অংশ থেকে আলাদা করার মত সমালোচনার যোগ্যতা তাদের মধ্যে থাকতে হবে। এবং এই সঙ্গে যা কিছু ভাঙ্গার তাকে ভেঙ্গে ফেলে তদস্থলে উন্নততর বস্তু গড়ার এবং যা কিছু রাখার তাকে কায়েম রেখে একটি উত্তম ও উন্নততর ব্যবস্থায় তাকে ব্যবহার করার মত গঠনমূলক যোগ্যতা ও শক্তির অধিকারী তাকে হতে হবে। 

ইসলামের প্রতি অবিচল বিশ্বাসঃ



এ উদ্দেশ্য সম্পাদনে ব্রতী ব্যক্তির মধ্যে জ্ঞানের পর দ্বিতীয় যে অপরিহার্য গুণটি থাকতে হবে সেটি হচ্ছে, যে দ্বীনের ভিত্তিতে সে জীবন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায় তার ওপর নিজেকে অবিচল ঈমান রাখতে হবে। ঐ জীবন ব্যবস্থার সত্যতা ও নির্ভুলতা সম্পর্কে তার নিজের মন নিঃসংশয় হতে হবে। সন্দেহ, সংশয় ও দোদুল্যমান অবস্থায় মানুষ এ কাজ করতে পারে না। মানসিক সংশয় এবং বিশৃখল চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। যে ব্যক্তির মন দোদুল্যমান, যার চিন্তা একাগ্র নয়, চিন্তা ও কর্মের বিভিন্ন পথ যাকে বিভ্রান্ত করে অথবা করতে পারে, সে ধরণের কোন লোক এ কাজের উপযোগী হতে পারে না। যে ব্যক্তি এ কাজ সম্পন্ন করবে তাকে নিঃসংশয় চিত্তে খোদার ওপর বিশ্বাস করতে হবে এবং কুরআনে বর্ণিত খোদার গুণাবলী, ক্ষমতা ও অধিকারের ওপর অবিচল ঈমান আনতে হবে। তাকে আখেরাতের ওপর অটল বিশ্বাস রাখতে হবে এবং কুরআনে আখেরাতের চিত্র যেভাবে বর্ণিত হয়েছে হুবহু সেভাবে বিশ্বাস করতে হবে। তাকে বিশ্বাস করতে হবে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (স) প্রদর্শিত পথই একমাত্র সত্য পথ এবং তার বিরোধী বা তার সাথে সামঞ্জস্যহীন প্রত্যেকটি পথই ভ্রান্ত। তাকে বিশ্বাস করতে হবে, মানুষের যে কোন চিন্তা ও যে কোন পদ্ধতি যাচাই করার একটি মাত্র মানদণ্ড আছে এবং তা হচ্ছে খোদার কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত। এ মানদণ্ডে যে উতরে যাবে সে সত্য ও অভ্রান্ত আর যে উতরে যাবে না সে বাতিল ও ভ্রান্ত। ইসলামী জীবন ব্যবস্থা পরিগঠনের জন্য এ সত্যগুলোর ওপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে এবং চিন্তার পূর্ণ একাগ্রতা লাভ করতে হবে। যে ব্যক্তি এ ব্যাপারে সামান্য দোদুল্যমান অবস্থায় বিরাজ করে অথবা এখনো অন্যান্য পথের প্রতি আগ্রহশীল তার এ প্রাসাদের কারিগর হিসেবে অগ্রসর হবার আগে নিজের এ দুর্বলতার চিকিৎসা প্রয়োজন।

চরিত্র ও কর্মঃ

তৃতীয় অপরিহার্য গুণটি হচ্ছে, কাজ কথা অনুযায়ী হতে হবে। যে বস্তুকে সে সত্য মনে করে তার অনুসরন করবে, যাকে বাতিল গণ্য করে তা থেকে দূরে সরে যাবে, যাকে নিজের দ্বীন ঘোষণা করে তাকে নিজের চরিত্র ও কর্মের দ্বীনে পরিণত করবে এবং যে বস্তুর দিকে সে বিশ্বাসীকে আহবান জানায় সর্বপ্রথম সে নিজে তার আনুগত্য করবে। সৎ কাজে আনুগত্য এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য তাকে বাইরে কোন চাপ প্রভাবের মুখাপেক্ষী হওয়া উচিৎ নয়। কোনো কাজ করলে খোদার সন্তুষ্টি লাভ করা যাবে, কেবল এতোটুকু কারণেই তার আন্তরিক আগ্রহ ও ইচ্ছা সহকারে ঐ কাজ সম্পন্ন করা উচিৎ। আবার কোন কাজ নিছক খোদার নিকট অপছন্দ হবার কারণেই সে তা থেকে বিরত থাকবে। তার এ চারিত্রিক বৈশিষ্ট কেবল সাধারণ অবস্থায় হওয়া উচিৎ নয় বরং তার চারিত্রিক শক্তি এতই উন্নত পর্যায়ের হতে হবে যে, অস্বাভাবিক বিকৃত পরিবেশে তাকে সকল প্রকার ভয়-ভীতি ও লোভ-লালসার মোকাবেলা করে এবং সবরকম বিরোধিতা ও প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেও সত্য পথে অবিচল থাকতে হবে। যার মধ্যে এ গুণ নেই সে সমাজ সংস্কার ও পরিগঠনের কাজে সাহায্যকারী হতে পারে কিন্তু সে প্রকৃত কর্মী হতে পারে না। ইসলামের জন্য যে ব্যক্তি নিজের মধ্যে সামান্যতম ভক্তি, শ্রদ্ধা ও দরদ রাখে সে এ কাজে সাহায্যকারী হতে পারে। এমনকি যে ব্যক্তি ইসলামের অস্বীকারকারী ও তার বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে তৎপর নয় সেও অনেকটা এর সহায়ক হতে পারে। কিন্তু এ ধরণের কোটি কোটি সাহায্যকারী থাকলেও কার্যতঃ ইসলামী ব্যবস্থা প্রবর্তিত হতে পারে না এবং জাহেলিয়াতের বিকাশ ও পরিপুষ্টি সাধনের গতি রুদ্ধ হতে পারে না। কার্যতঃ এ কাজ একমাত্র তখনই সম্পাদিত হতে পারে, যখন এর জন্য এমন একদল লোক সামনে অগ্রসর হবে যারা জ্ঞান ও বিশ্বাসের সাথে চরিত্র ও কর্মশক্তি সমন্বিত হবে এবং যাদের ঈমান ও বিবেক এতো বিপুল জীবনী-শক্তির ধারক হবে যার ফলে বাইরের কোন উস্কানী ছাড়াই নিজেদের আভ্যন্তরীণ তাকীদে তার দ্বীনের চাহিদা ও দাবী পূরণ করতে থাকবে। এ ধরণের কর্মীরা যদি ময়দানে নেমে আসে তাহলে মুসলিম সমাজে এমনকি অমুসলিম সমাজেও সর্বত্র যে বিপুল সংখ্যক সমর্থক ও সাহায্যকারী পাওয়া যায় তাদের উপস্থিতিও ফলপ্রসূ হতে পারে।

দ্বীন হচ্ছে জীবনোদ্দেশ্যঃ

সমাজ সংস্কার ও পরিগঠনে ব্রতী কর্মীদের মধ্যে এ তিনটি গুণাবলীর সাথে সাথে আর একটি গুণ থাকতে হবে। তা হলো খোদার বাণী বুলন্দ করা এবং দ্বীনের প্রতিষ্ঠা নিছক তাদের জীবনের একটি আকাঙ্খার পর্যায়ভূক্ত হবে না বরং এটিকে তাদের জীবনোদ্দেশ্যে পরিণত করতে হবে। এক ধরণের লোক দ্বীন সম্পর্কে অবগত হয়, তার উপর ঈমান রাখে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে কিন্তু তার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম তাদের জীবনের লক্ষ্য বিবেচিত হয় না বরং সততা ও সৎকর্ম করে এবং এই সঙ্গে নিজেদের দুনিয়ার কাজ কারবারে লিপ্ত থাকে। নিঃসন্দেহে এরা সৎ লোক। ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কার্যতঃ প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকলে এরা তার ভাল নাগরিকও হতে পারে। কিন্তু যেখানে জাহেলী জীবনব্যবস্থা চর্তুদিক আচ্ছন্ন করে রাখে এবং তাকে সরিয়ে তদস্থলে ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার প্রশ্ন দেখা দেয় সেখানে নিছক এ ধরণের সৎলোকদের উপস্থিতি কোনো কাজে আসে না বরং সেখানে এমন সব লোকের প্রয়োজন হয় যাদের জীবনোদ্দেশ্যরুপে এ কাজ বিবেচিত হয়। দুনিয়ার অন্যান্য কাজ তারা অবশ্যি করবে কিন্তু তাদের জীবন একমাত্র এ উদ্দেশ্যের চারিদিকে আবর্তন করবে। এ উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্য তারা হবে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। এ জন্যে নিজেদের সময়-সামর্থ, ধন-মাল ও দেহ-প্রাণের সকল শক্তি এবং মন মস্তিষ্কের পরিপূর্ণ যোগ্যতা ব্যয় করতে তারা প্রস্তুত হবে। এমন কি যদি জীবন উৎসর্গ করার প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে তাতেও তারা পিছপা হবে না। এ ধরণের লোকেরাই জাহেলিয়াতের আগাছা কেটে ইসলামের পথ পরিস্কার করতে পারে।


দ্বীনের সঠিক নির্ভুল জ্ঞান, তার প্রতি অটল বিশ্বাস, সেই অনুযায়ী চরিত্র গঠন এবং তার প্রতিষ্ঠাকে জীবনোদ্দেশ্যে পরিণত করা এগুলো এমন সব মৌলিক গুণ যেগুলো ব্যক্তিগতভাবে ইসলামী জীবনব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টারত প্রত্যেকটি ব্যক্তির মধ্যে থাকা উচিৎ। এগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। অর্থাৎ এ গুনাবলীর অধিকারী ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ ছাড়া এ কাজ সম্পাদনের কল্পনাই করা যেতে পারে না।


বলাবাহুল্য, এহেন ব্যক্তিরা যদি সত্যিই কিছু করতে চায় তাহলে তাদের একটি দলভুক্ত হয়ে এ কাজ করা অপরিহার্য। তারা যে কোন দল-ভুক্ত হোক এবং যে কোন নামে কাজ করুক না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। প্রত্যেক বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি জানে, নিছক ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় সমাজব্যবস্থায় কোন পরিবর্তন আনা যেতে পারে না। এজন্যে বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা নয়, সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। কাজেই একে একটি সর্ববাদী সম্মত সত্য মনে করে এখন আমরা এ ধরণের দলের মধ্যে দলীয় যে সব গুণ থাকা অপরিহার্য সেগুলোর আলোচনায় প্রবৃত্ত হবো।