আল-কুরআন নিছক কোন মতবাদ ও চিন্তাধারার বই নয়

"আল-কুরআন নিছক কোন মতবাদ ও চিন্তাধারার বই নয়, তাই আরাম কেদারায় বসে বসে পড়েই এর সব কথা কারো পক্ষে বুঝতে পারা সম্ভব নয়। দুনিয়ার প্রচলিত ধর্মগ্রন্থগুলোর মতন এটা নিছক একটি ধর্মগ্রন্থ নয় যার সমস্ত রহস্য ও গভীর তত্ত্ব শিক্ষাঙ্গনে ও উপাসনালয়ে বসে বসে উদ্ধার করা সম্ভব।

পক্ষান্তরে, কুরআন এমনই একটি গ্রন্থ যাতে রয়েছে একটি বাণী, একটি দাওয়াত, যা আন্দোলনের সৃষ্টি করে। কুরআন পৃথিবীর বুকে নাযিল হয়েই এক নীরব প্রকৃতির সৎ ও সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিকে তার নির্জন ও নিসর্গ জীবনক্ষেত্র থেকে বের করে এনে আল্লাহবিরোধী দুনিয়ার মোকাবিলায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই কুরআন তার কন্ঠে যুগিয়েছে বাতিলের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদের ধ্বনি। এটি যুগের কুফুরি, ফাসিকী ও ভ্রষ্টতার পতাকাবাহীদের বিরুদ্ধে তাকে প্রচণ্ড সংঘাতে লিপ্ত করেছে।

উন্নত এবং সৎ চরিত্রের লোকদেরকে একজন একজন করে প্রতিটি গৃহাভ্যন্তর থেকে খুঁজে বের করে এনে সত্যের আহবায়কের পতাকাতলে সমবেত করেছে আল-কুরআন। দেশের প্রতিটি এলাকার ফিতনাবাজ ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে এই কুরআন বিক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত করে সত্যানুসারীদের সাথে তাদের যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়েছে।"

-- সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী (রাহিমাহুল্লাহ)

সূত্র : কুরআন অধ্যয়ন সহায়িকা, খুররম মুরাদ, পৃষ্ঠা ১৩৩

দুনিয়াটা যেন একটা রেলগাড়ী

"দুনিয়াটা যেন একটা রেলগাড়ী। একে চালিত করছে চিন্তা-গবেষণা ও তথ্যানুসন্ধানের ইঞ্জিন। আর চিন্তাবিদ ও তথ্যানুসন্ধানীরা ও হচ্ছে এই ইঞ্জিনের ড্রাইভার। তাঁরা এই গাড়িকে যেদিকে চালিত করেন, সেইদিকেই সে ধাবিত হয়। যারা গাড়ীর আরোহী, তারা ইচ্ছায় হোক কি অনিচ্ছায়-তার গতিপানেই যেতে বাধ্য। যদি গাড়ির কোনো যাত্রী তার গতিপানে যেতে অনিচ্ছুক হয়, তাহলে সে চলন্ত গাড়ীর মধ্যে বসে নিজের আসনটিকে এদিক-ওদিক ঘুরানো চাড়া আর কিছুই করতে পারেনা। কিন্তু আসনের মোড় ঘুরিয়ে দিলেই তাতে নিজের গতিমুখ বদলানো যায় না; তা করতে হলে গাড়ীর ইঞ্জিন দখল করে তার গতিকে নিজের ইপ্সিত পথে ঘুরিয়ে দিতে হবে। একমাত্র এভাবেই নিজের গতিমুখ বদলানো যেতে পারে।

বর্তমানে এই ইঞ্জিনটি যাদের করায়ত্ত, তার সবাই আল্লাহবিমুখ এবং ইসলামী চিন্তাধারা সম্পর্কে নিদারুন অজ্ঞ। এ জন্যেই গাড়িটি তার যাত্রীদের নিয়ে ধর্মদ্রোহীতা ও বস্তুতান্ত্রিকতার পথে দ্রুত ছুটে চলছে। ফলে সমস্ত যাত্রীই ইসলামের লক্ষ্যস্থল থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। তাই গাড়ীর এই গতিধারাকে বদলাতে হলে আজ থেকে ইঞ্জিন করায়ত্ত্বের চেষ্টা করতে হবে। এই কাজটি যে পর্যন্ত না হবে, সে পর্যন্ত গাড়ীর গতি কিছুতেই বদলানো যাবেনা; বরং আমাদের শত আপত্তি-বিরক্তি ও চিৎকার সত্ত্বেও গাড়ী আল্লাহদ্রোহী ড্রাইভারদের নির্দেশিত পথেই চলতে থাকবে।"

-সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী (ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব, পৃঃ ১৭)


"যারা আপন চিন্তাধারা, নৈতিকতা,সামাজিকতা‌,অর্থনীতি,শিক্ষাদীক্ষা তথা জীবনের কোন একটি জিনিসেও মুসলমান নয় এবং মুসলমান থাকতে ইচ্ছুকও নয়,তাদের নামমাত্র মুসলমান থাকায় ইসলামের আদৌ কোন ফায়দা নেই বরং ক্ষতিই সমাধিক।তারা খোদা পূজারী নয়, বরং হাওয়া(প্রবৃত্তি) পূজারী।দুনিয়ায় যদি মূর্তি পূজার প্রাবল্য দেখা দেয় তো এরা নিশ্চিতভাবে মূর্তি পূজা শু্রু করে দিবে।দুনিয়ায় যদি নগ্নতার প্রচলন হয় তো এরা অবশ্যই পরিধেয় খুলে ফেলবে।এদের মন-মগজ হচ্ছে গোলাম,তাই গোলামীর জন্য এরা উন্মুখ হয়ে আছে।এদের জীবনে ফিরিঙ্গিপনার প্রাবল্য রয়েছে,এজন্যই নিজেদের গোপন থেকে প্রকাশ্য পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই এরা ফিরিঙ্গি হতে ইচ্ছুক।আবার কাল যদি হাবশীদের প্রধান্য দেখা দেয়, তাহলে অবশ্যই এরা হাবশী হবার প্রয়াস পাবে নিজেদের মুখমণ্ডলে কালি মেখে নিবে,ওষ্ঠাধর মোটা করবে,মাথার চুল হাবশীদের ন্যায় কুঞ্চিত করবে,......।ইসলামের পক্ষে এমন গোলামের  কোন প্রয়োজন নাই। (ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব

গোত্রবাদ, বর্ণবৈষম্য ও স্বদেশিকতা

গোত্রবাদঃ

গোত্রবাদ বা বংশবাদ আধুনিক কালের জাতীয়তার একটি প্রধান ভিত্তি। কিন্তু এ গোত্রবাদের অর্থ কি? নিছক রক্তের সম্পর্ক ও একত্বেরই নাম হচ্ছে গোত্রবাদ। একই পিতা ও মাতার ঔরসজাত হওয়ার দিক দিয়ে কিছু সংখ্যক লোকের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক স্থাপিত হয়; এটাই হচ্ছে বংশবাদের প্রথম ভিত্তি। এটাই সম্প্রসারিত হয়ে একটি পরিবাররূপে আত্মপ্রকাশ করে, এটা হতেই হয় গোত্র এবং বংশ। এ শেষ সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে মানুষ তার বংশের আদি পিতা থেকে এতদূরে গিয়ে উপনীত হয় যে, তখন তার উত্তরাধিকারত্ব নিছক কাল্পনিক বস্তুতে পরিণত হয়।

তথাকথিত এ বংশের সমুদ্রে বহিরাগত রক্তের অসংখ্য নদীনালার সংগম হয়। কাজেই উক্ত সমুদ্রের 'পানি' যে সম্পূর্ণ খাঁটি ও অবিমিশ্রিত-তার আসল উৎস থেকে উৎসারিত হয়ে পানি ছাড়া তাতে অন্য কোনো পানির ধারা মিশ্রিত হয়নি, জ্ঞান-বুদ্ধি সমন্বিত কোনো ব্যক্তিই এরূপ দাবী করতে পারে না। এরূপ সংমিশ্রণের পরও একই রক্তের সামঞ্জস্য মানুষ একটি বংশকে নিজেদের মিলন কেন্দ্ররূপে গ্রহণ করতে পারে। তাহলে আদি পিতা ও আদি মাতার রক্তের যে একত্ব দুনিয়ার সমগ্র মানুষকে পরস্পর মিলিত করে, তাকে ঐক্যের ভিত্তিস্বরূপ কেন গ্রহণ করা যেতে পারে না? আর দুনিয়র নিখিল মানুষকে একই বংশোদ্ভূত ও একই গোত্র বলে কেন মনে করা যাবে না?

আজ যেসব লোককে বিভিন্ন বংশ বা গোত্রের প্রতিষ্ঠাতা বা 'প্রথম পুরুষ' বলে মনে করা হয়, তাদের সকলেরই পূর্ব পুরুষ উর্দ্ধদিকে কোথাও না কোথাও এক ছিল এবং শেষ পর্যন্ত এ সকলকেই একই মূল সূত্র থেকে উদ্ভূত বলে স্বীকার করতে হবে। তাহলে 'আর্য' ও 'অনার্য' নামে মানুষের মধ্যে এ বিভেদ কিরূপে স্বীকার করা যেতে পারে?

বর্ণবৈষম্যঃ

মানব সমাজে বর্ণবৈষম্য সর্বাপেক্ষা অধিক কদর্য ও অর্থহীন ব্যাপার। বর্ণ কেবল দেহের একটি বাহ্যিক গুণমাত্র; কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, মানুষ মনুষত্বের মর্যাদা তার দেহের জন্য লাভ করেনি, তার আত্মা ও মানবিকতাই হচ্ছে এ মর্যাদা লাভের একমাত্র কারণ। অথচ এর রঙ বা বর্ণ বলতে কিছু নেই। এমতাবস্থায় মানুষের মধ্যে লাল, হলুদ, কৃষ্ণ ও শ্বেত প্রভৃতি বর্ণের দিক দিয়ে পার্থক্য করার কি যুক্তি থাকতে পারে? কৃষ্ণ বর্ণের গাভী ও শ্বেত বর্ণের গাভীর দুধের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা যায় না। কারণ দুধই সেখানে মুখ্য, সেখানে রক্ত বা বর্ণের কোনোই গুরুত্ব নেই। কিন্তু মানুষের দেউলিয়া বুদ্ধি আজ মানুষের আভ্যন্তরীণ গুণ-গরিমা থেকে তার দেহাবরণের বর্ণের দিকে আমাদেরকে আকৃষ্ট করেছে। এটা অপেক্ষা মর্মান্তিক দুরবস্থা আর কি হতে পারে?

স্বদেশিকতাঃ

স্বদেশিকতার ঐক্য গোত্রবাদ অপেক্ষাও অস্পষ্ট ও অমূলক। যে স্থানে মানুষের জন্ম হয়, তার পরিধি এক বর্গ গজের অধিক নিশ্চয় হয় না। এতোটুকু স্থানকে যদি সে নিজের স্বদেশ বলে মনে করে, তাহলে বোধ হয় সে কোনো দেশকেই নিজের স্বদেশ বলতে পারে না। কিন্তু সে এ ক্ষুদ্রতম স্থানের চর্তুদিকে শত-সহস্র মাইল ব্যাপী সীমা নির্ধারণ করে ও এ সীমান্তবর্তী স্থানকে সে 'স্বদেশ' বলে অভিহিত করে এবং উক্ত সীমারেখা বর্হিভূত এলাকা র সাথে তার কোনোই সম্পর্ক নেই বলে অকুন্ঠিতভাবে প্রকাশ করে। মূলত এটা তার একমাত্র দৃষ্টিসংকীর্ণতা ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্যকথায় গোটা পৃথিবীকে তারা নিজের বলে অভিহিত করতে কোনোই বাঁধা ছিলো না। এক 'বর্গগজ' পরিমিত স্থানের 'স্বদেশ' যে যুক্তির বলে সম্প্রসারিত হয়ে শত-সহস্র বর্গমাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে, ঠিক সেই যুক্তিতেই তা আরো অধিকতর বিস্তার লাভ করে নিখিল বিশ্ব তার স্বদেশে পরিণত হতে পারে।

নিজের দৃষ্টিকোণ সংকীর্ণ না করলে মানুষ স্পষ্টভাবে দেখতে পারে যে, নদী-সমুদ্র, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি যা কিছুকেই কাল্পনিকভাবে সীমারেখা হিসাবে ধরে নিয়ে একটি এলাকাকে অপর একটি এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখে, প্রকৃতপক্ষে তা একই বিশাল পৃথিবীর অংশবিশেষ; কাজেই এ পাহাড়-পর্বত ও নদী-সমুদ্র তাকে সীমাবদ্ধ একটি এলাকায় কিরূপে বন্দী করে দিতে পারে? সে নিজেকে সমগ্র পৃথিবীর অধিবাসী বলে মনে করে না? সারা দুনিয়াকে সে তার 'স্বদেশ' বা জন্মভূমি বলে মনে করলে সে নিজেকে গোটা ভূপৃষ্ঠের অধিবাসী বলে কেন মনে করে না? সারা দুনিয়াকে সে তার স্বদেশ বা জন্মভূমি বলে মনে করলে আর ভূ-পৃষ্ঠের অধিবাসী সমগ্র মনুষ্যজাতিকে 'স্বদেশবাসী' বলে অভিহিত করলে এবং ভূমিষ্ঠ হওয়ার নির্দিষ্ট স্থানটুকুতে তার যে অধিকার আছে, সমগ্র বিশ্বজগতের উপরও সেই অধিকার দাবী করলে তা ভুল হবে কেন?

:: সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী ::

ইসলামী আন্দোলন :: সাফল্যের শর্তাবলী [পর্ব ৩]

৪) মৌলিক ও অসৎ গুণাবলী

ক) গর্ব ও অহংকারঃ


সমস্ত সৎগুণের মুলোৎপাটনকারী প্রধানতম ও সবচাইতে মারাত্মক অসৎ গুণ হচ্ছে গর্ব অহংকার, আত্মাভিমান ও নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ। এটি একটি শয়তানী প্রেরণা এবং শয়তানী কাজেরই উপযোগী হতে পারে। শ্রেষ্ঠত্ব একমাত্র আল্লাহর সাথে সংযুক্ত। (তাই এ অসৎগুণ সহকারে কোন সৎকাজ করা যেতে পারে না)। 

বান্দাহর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব ও অহংকার একটি নির্জলা মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। যে ব্যক্তি বা দল এ মিথ্যা গর্ব-অহংকারে লিপ্ত থাকে সে খোদার সব রকমের সমর্থন থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ আল্লাহ নিজের বান্দাহর মধ্যে এ বস্তুটিই সবচাইতে বেশী অপছন্দ করেন। ফলে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি কোন ক্রমেই সঠিক পথ লাভ করতে পারে না। সে অনবরত মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিতে থাকে। এভাবে অবশেষে ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়। ফলে মানুষের সাথে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সে যতই গর্ব ও অহংকারের প্রকাশ করে ততই তার বিরুদ্ধে ঘৃণার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এমনকি অবশেষে সে মানুষের চোখে ঘৃণিত হয়ে এমন পর্যায়ে উপনীত হয় যার ফলে মানুষের ওপর তার কোন নৈতিক প্রভাব কায়েম থাকে না। 

ইসলামী আন্দোলন সাফল্যের শর্তাবলী [পর্ব ২]

২) দলীয় গুণাবলী 


ক) ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসাঃ


এ ধরণের দলের মধ্যে সর্বপ্রথম যে গুণটি থাকতে হবে তা হচ্ছে, তার অর্ন্তভূক্ত প্রত্যেক ব্যক্তিকে পরস্পরের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। প্রাসাদের প্রত্যেকটা ইট মজবুতভাবে একটার সাথে আরেকটা মিশে থাকলে তবে প্রাসাদটি মজবুত হয়। সিমেন্ট এ ইটগুলোকে পরস্পরের সাথে মিশিয়ে রাখে। তেমনিভাবে কোন দলের সদস্যদের দিল পরস্পরের সাথে একসূত্রে গাঁথা থাকলে তবেই তা ইস্পাত প্রাচীরে পরিণত হয়। আর এ দিলগুলোকে একসূত্রে গাঁথতে পারে আন্তরিক ভালোবাসা, পারস্পারিক কল্যাণাকাঙ্খা, সহানুভূতি ও পরস্পরের জন্য ত্যাগ স্বীকার। ঘৃণাকারী দিল কখনো পরস্পরে মিলেমিশে থাকতে পারে না। মোনাফেকী ধরণের মেলামেশা কখনো সত্যিকার ঐক্য সৃষ্টি করতে পারে না। স্বার্থবাদী ঐক্য মোনাফেকীর পথ প্রশস্ত করে। আর নিছক একটি শুষ্ক-নীরস ব্যবসায়িক সম্পর্ক কোন সৌহার্দ্য ও সহযোগিতার ভিত্তিতে পরিণত হতে পারে না। কোন পার্থিব স্বার্থ এ ধরণের সম্পর্কহীন লোকদেরকে একত্রিত করলেও তারা নিছক বিক্ষিপ্ত হবার জন্যই একত্রিত হয় এবং কোন মহৎ কাজ সম্পাদনের পরিবর্তে নিজেদের মধ্যে হানাহানী করেই শেষ হয়ে যায়। 

যখন একদল নিঃস্বার্থ চিন্তার অধিকারী ও জীবনোদ্দেশ্যের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগী লোক একত্রিত হয় অতঃপর চিন্তার এই নিঃস্বার্থতা ও উদ্দেশ্যের প্রতি এ অনুরাগ তাদের নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতা ও ভালোবাসার সৃষ্টি করে কেবল মাত্র তখনই একটি মজবুত ও শক্তিশালী দলের সৃষ্টি হতে পারে। এ ধরণের দল আসলে ইস্পাত প্রাচীরের ন্যায় অটুট হয়। শয়তান এর মধ্যে ফাটল ধরাবার কোন পথই পায় না। আর বাহির থেকে বিরোধীতার তুফান এনে এর বিরুদ্ধে দাঁড় করালেও একে স্থানচ্যুত করতে পারে না।

ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী [পর্ব ১]

যারা সত্যিই একটি ইসলামী সমাজ কায়েম করতে চান তাদের 

সর্বপ্রথম ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে, আমাদের জাতির মধ্যে একটি আদর্শ ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খার মোটেই অভাব নেই। আসল অভাব আগ্রহ ও উদ্যোগ গ্রহণের এবং তার চাইতে বেশী অভাব যোগ্যতার। এ কাজের জন্য যে মৌলিক গুণাবলীর প্রয়োজন অধিকাংশ লোকের মধ্যে তা অনুপস্থিত।


দ্বিতীয় যে বিষটির প্রতি তীক্ষ নজর রাখতে হবে তা হচ্ছে আমাদের জাতির সমগ্র প্রভাবশালী অংশ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজে বিকৃতি ও ভাঙ্গন সৃষ্টিতে মুখর। আর যারা বিকৃতি ও ভাঙ্গনের কাজে লিপ্ত নেই তারাও সৃষ্টি ও বিন্যাসের চিন্তামুক্ত। সমাজ সংস্কার ও গঠনের প্রচেষ্টারত ব্যক্তিদের সংখ্যা মুষ্টিমেয়। 


তৃতীয় যে বিষয়টি থেকে উচিৎ নয় সেটি হচ্ছে, বর্তমান যুগে সমাজ জীবন পরিগঠণ ও ভাঙ্গার বৃহত্তম শক্তি হচ্ছে সরকার। আর যেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকে সেখানে জনগনের উপযুক্ততা বা অনুপযুক্ততা ব্যক্তিদের হাতে শাসন ক্ষমতা সোপর্দ করার ওপরই সরকারের উপযুক্ত বা অনুপযুক্ত পূর্ণতঃ নির্ভরশীল। ভাঙ্গার কাজে যারা লিপ্ত থাকে তারা জনগণ যাতে কোনদিন নির্ভুল নির্বাচনের যোগ্য না হতে পারে সেজন্যে জনগণকে প্ররোচিত করার কাজে যতো শক্তি ব্যয় করে অন্য কাজে ততো ব্যয় করে না।

আরবে যখন কোরআন পেশ করা হয়

আরবে যখন কোরআন পেশ করা হয়,তখন প্রত্যেকেই জানতো ইলাহ অর্থ কি,রব কাকে বলা হয়।কারণ তাদের কথাবার্তায় এ শব্দদ্বয় পূর্ব হতে প্রচলিত ছিল।তারা জানত এ শব্দগুলোর অর্থ কি,কি এর তাৎপর্য।কিন্তু কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় এ শব্দগুলোর যে মৌল অর্থ প্রচলিত ছিল,পরবর্তী শতকে ধীরে ধীরে তা পরিবর্তিত হতে থাকে।শেষ পর্যন্ত এক-একটি শব্দ তার সম্পূর্ণ ব্যপকতা হারিয়ে একান্ত সীমিত বরং অস্পষ্ট অর্থের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে পরে।

এর কারন ছিলো (1)আরবী ভাষার প্রতি সঠিক স্পৃহার অভাব (2)দ্বিতীয় কারণ ছিল ইসলামী সমাজে যেসব ব্যক্তির উদ্ভব হয়েছে,তাদের কাছে ইলাহ,রব,দ্বীন,ইবাদতের সে অর্থ অবশিষ্ট ছিলোনা,যা কোরআন নাযিল হওয়ার সময় অমুসলিম সমাজে প্রচলিত ছিল।

এ কারনে পরবর্তী কালের অভিধান ও তাফসীর গ্রন্থে অধিকাংশ কোরানিক শব্দের ব্যখ্যা করা হয়েছে আভিধানিক অর্থের পরিবর্তে এমন সব অর্থে যা পরবর্তী কালের মুসলমানরা বুঝতো।যেমন:
ইলাহ শব্দকে মূর্তি ও দেবতার সমার্থক করা হয়েছে।লালন-পালন কর্তা বা পরওয়ারদেগার এর প্রতিশব্দ করা হয়েছে রব'কে,ইবাদতের অর্থ করা হয়েছে পূজা-উপাসনা,ধর্ম,মযহাব এবং রিলিজিয়ান এর সমার্থজ্ঞাপক শব্দ করা হয়েছে দীনকে।তাগুত-এর তর্জমা করা হয়েছে মূর্তি বা শয়তান।

ফল দাঁড়ালো এই যে,কোরআনের মৌল উদ্দেশ্য অনুধাবন করাই লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়লো।
এটা সত্য যে,কেবল এ চারটি মৌলিক পরিভাষার তাৎপর্যে আবরণ পরে যাওয়ার কারনে কোরআনের তিন-চতুর্থাংশের চেয়েও বেশী শিক্ষা বরং তার সত্যিকার স্পিরিটই দৃষ্টি থেকে প্রচ্ছন্ন হয়ে যায়।ইসলাম কবুল করা সত্ত্বেও মানুষের আকীদা-আমল-বিশ্বাস ও কর্মে যে সকল ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছে,এটা তার অন্যতম প্রধান কারন।

সুতরাং কোরআনুল করীমের মৌল শিক্ষা এবং তার সত্যিকার লক্ষ্য স্পষ্ট করে তুলে ধরার জন্য এর পরিভাষাগুলোর সঠিক ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা একান্ত জরুরী। 
 
(কোরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা,সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী,পৃষ্ঠা ১১-১৩(সূচনা)থেকে সংগৃহীত)

ইসলাম ভীরু কাপুরুষদের জন্য অবতীর্ন হয়নি

"ইসলাম ভীরু কাপুরুষদের জন্য অবতীর্ন হয়নি, বাতাসের বেগে উড়ে চলা খড় কুটোর জন্য অবতীর্ন হয়নি। ইসলাম এমন এক নরশার্দুলদের জন্য অবতীর্ন হয়েছে, যারা বাতাসের গতি বদলে দেওয়ার দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করে।"


-- সাইয়্যেদ আবুল আ'লা [১৯০৩-১৯৭৯]

যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তানায়কের আবির্ভাব না ঘটবে

যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তানায়কের আবির্ভাব না ঘটবে, ততোক্ষন এই নতজানু অবস্থার অবসান হবেনা। বস্তুত আজ ইসলামের এক নবজাগরণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। প্রাচীন ইসলামী চিন্তানায়ক ও তথ্যানুসন্ধানীদের রক্ষিত জ্ঞানসম্পদ আজকের দিনে ফলপ্রসু হতে পারেনা; কেননা দুনিয়া আজকে অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। ছয়শ বছর আগে দুনিয়া যেসব পর্যায় অতিক্রম করে এসেছে, আজ তাকে আবার পেছন দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। আজকে যে দুনিয়াকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে, জ্ঞান ওকর্মের ক্ষেত্রে সে-ই নেতৃত্বদানে সক্ষম হবে।

         -সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী (ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব, পৃঃ ১৬)

দুনিয়াটা যেন একটা রেলগাড়ী

"দুনিয়াটা যেন একটা রেলগাড়ী। একে চালিত করছে চিন্তা-গবেষণা ও তথ্যানুসন্ধানের ইঞ্জিন। আর চিন্তাবিদ ও তথ্যানুসন্ধানীরা ও হচ্ছে এই ইঞ্জিনের ড্রাইভার। তাঁরা এই গাড়িকে যেদিকে চালিত করেন, সেইদিকেই সে ধাবিত হয়। যারা গাড়ীর আরোহী, তারা ইচ্ছায় হোক কি অনিচ্ছায়-তার গতিপানেই যেতে বাধ্য। যদি গাড়ির কোনো যাত্রী তার গতিপানে যেতে অনিচ্ছুক হয়, তাহলে সে চলন্ত গাড়ীর মধ্যে বসে নিজের আসনটিকে এদিক-ওদিক ঘুরানো চাড়া আর কিছুই করতে পারেনা। কিন্তু আসনের মোড় ঘুরিয়ে দিলেই তাতে নিজের গতিমুখ বদলানো যায় না; তা করতে হলে গাড়ীর ইঞ্জিন দখল করে তার গতিকে নিজের ইপ্সিত পথে ঘুরিয়ে দিতে হবে। একমাত্র এভাবেই নিজের গতিমুখ বদলানো যেতে পারে।

বর্তমানে এই ইঞ্জিনটি যাদের করায়ত্ত, তার সবাই আল্লাহবিমুখ এবং ইসলামী চিন্তাধারা সম্পর্কে নিদারুন অজ্ঞ। এ জন্যেই গাড়িটি তার যাত্রীদের নিয়ে ধর্মদ্রোহীতা ও বস্তুতান্ত্রিকতার পথে দ্রুত ছুটে চলছে। ফলে সমস্ত যাত্রীই ইসলামের লক্ষ্যস্থল থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। তাই গাড়ীর এই গতিধারাকে বদলাতে হলে আজ থেকে ইঞ্জিন করায়ত্ত্বের চেষ্টা করতে হবে। এই কাজটি যে পর্যন্ত না হবে, সে পর্যন্ত গাড়ীর গতি কিছুতেই বদলানো যাবেনা; বরং আমাদের শত আপত্তি-বিরক্তি ও চিৎকার সত্ত্বেও গাড়ী আল্লাহদ্রোহী ড্রাইভারদের নির্দেশিত পথেই চলতে থাকবে।"

-সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী (ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব, পৃঃ ১৭)