দুনিয়াটা যেন একটা রেলগাড়ী

"দুনিয়াটা যেন একটা রেলগাড়ী। একে চালিত করছে চিন্তা-গবেষণা ও তথ্যানুসন্ধানের ইঞ্জিন। আর চিন্তাবিদ ও তথ্যানুসন্ধানীরা ও হচ্ছে এই ইঞ্জিনের ড্রাইভার। তাঁরা এই গাড়িকে যেদিকে চালিত করেন, সেইদিকেই সে ধাবিত হয়। যারা গাড়ীর আরোহী, তারা ইচ্ছায় হোক কি অনিচ্ছায়-তার গতিপানেই যেতে বাধ্য। যদি গাড়ির কোনো যাত্রী তার গতিপানে যেতে অনিচ্ছুক হয়, তাহলে সে চলন্ত গাড়ীর মধ্যে বসে নিজের আসনটিকে এদিক-ওদিক ঘুরানো চাড়া আর কিছুই করতে পারেনা। কিন্তু আসনের মোড় ঘুরিয়ে দিলেই তাতে নিজের গতিমুখ বদলানো যায় না; তা করতে হলে গাড়ীর ইঞ্জিন দখল করে তার গতিকে নিজের ইপ্সিত পথে ঘুরিয়ে দিতে হবে। একমাত্র এভাবেই নিজের গতিমুখ বদলানো যেতে পারে।

বর্তমানে এই ইঞ্জিনটি যাদের করায়ত্ত, তার সবাই আল্লাহবিমুখ এবং ইসলামী চিন্তাধারা সম্পর্কে নিদারুন অজ্ঞ। এ জন্যেই গাড়িটি তার যাত্রীদের নিয়ে ধর্মদ্রোহীতা ও বস্তুতান্ত্রিকতার পথে দ্রুত ছুটে চলছে। ফলে সমস্ত যাত্রীই ইসলামের লক্ষ্যস্থল থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। তাই গাড়ীর এই গতিধারাকে বদলাতে হলে আজ থেকে ইঞ্জিন করায়ত্ত্বের চেষ্টা করতে হবে। এই কাজটি যে পর্যন্ত না হবে, সে পর্যন্ত গাড়ীর গতি কিছুতেই বদলানো যাবেনা; বরং আমাদের শত আপত্তি-বিরক্তি ও চিৎকার সত্ত্বেও গাড়ী আল্লাহদ্রোহী ড্রাইভারদের নির্দেশিত পথেই চলতে থাকবে।"

-সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী (ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব, পৃঃ ১৭)


"যারা আপন চিন্তাধারা, নৈতিকতা,সামাজিকতা‌,অর্থনীতি,শিক্ষাদীক্ষা তথা জীবনের কোন একটি জিনিসেও মুসলমান নয় এবং মুসলমান থাকতে ইচ্ছুকও নয়,তাদের নামমাত্র মুসলমান থাকায় ইসলামের আদৌ কোন ফায়দা নেই বরং ক্ষতিই সমাধিক।তারা খোদা পূজারী নয়, বরং হাওয়া(প্রবৃত্তি) পূজারী।দুনিয়ায় যদি মূর্তি পূজার প্রাবল্য দেখা দেয় তো এরা নিশ্চিতভাবে মূর্তি পূজা শু্রু করে দিবে।দুনিয়ায় যদি নগ্নতার প্রচলন হয় তো এরা অবশ্যই পরিধেয় খুলে ফেলবে।এদের মন-মগজ হচ্ছে গোলাম,তাই গোলামীর জন্য এরা উন্মুখ হয়ে আছে।এদের জীবনে ফিরিঙ্গিপনার প্রাবল্য রয়েছে,এজন্যই নিজেদের গোপন থেকে প্রকাশ্য পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই এরা ফিরিঙ্গি হতে ইচ্ছুক।আবার কাল যদি হাবশীদের প্রধান্য দেখা দেয়, তাহলে অবশ্যই এরা হাবশী হবার প্রয়াস পাবে নিজেদের মুখমণ্ডলে কালি মেখে নিবে,ওষ্ঠাধর মোটা করবে,মাথার চুল হাবশীদের ন্যায় কুঞ্চিত করবে,......।ইসলামের পক্ষে এমন গোলামের  কোন প্রয়োজন নাই। (ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব

গোত্রবাদ, বর্ণবৈষম্য ও স্বদেশিকতা

গোত্রবাদঃ

গোত্রবাদ বা বংশবাদ আধুনিক কালের জাতীয়তার একটি প্রধান ভিত্তি। কিন্তু এ গোত্রবাদের অর্থ কি? নিছক রক্তের সম্পর্ক ও একত্বেরই নাম হচ্ছে গোত্রবাদ। একই পিতা ও মাতার ঔরসজাত হওয়ার দিক দিয়ে কিছু সংখ্যক লোকের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক স্থাপিত হয়; এটাই হচ্ছে বংশবাদের প্রথম ভিত্তি। এটাই সম্প্রসারিত হয়ে একটি পরিবাররূপে আত্মপ্রকাশ করে, এটা হতেই হয় গোত্র এবং বংশ। এ শেষ সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে মানুষ তার বংশের আদি পিতা থেকে এতদূরে গিয়ে উপনীত হয় যে, তখন তার উত্তরাধিকারত্ব নিছক কাল্পনিক বস্তুতে পরিণত হয়।

তথাকথিত এ বংশের সমুদ্রে বহিরাগত রক্তের অসংখ্য নদীনালার সংগম হয়। কাজেই উক্ত সমুদ্রের 'পানি' যে সম্পূর্ণ খাঁটি ও অবিমিশ্রিত-তার আসল উৎস থেকে উৎসারিত হয়ে পানি ছাড়া তাতে অন্য কোনো পানির ধারা মিশ্রিত হয়নি, জ্ঞান-বুদ্ধি সমন্বিত কোনো ব্যক্তিই এরূপ দাবী করতে পারে না। এরূপ সংমিশ্রণের পরও একই রক্তের সামঞ্জস্য মানুষ একটি বংশকে নিজেদের মিলন কেন্দ্ররূপে গ্রহণ করতে পারে। তাহলে আদি পিতা ও আদি মাতার রক্তের যে একত্ব দুনিয়ার সমগ্র মানুষকে পরস্পর মিলিত করে, তাকে ঐক্যের ভিত্তিস্বরূপ কেন গ্রহণ করা যেতে পারে না? আর দুনিয়র নিখিল মানুষকে একই বংশোদ্ভূত ও একই গোত্র বলে কেন মনে করা যাবে না?

আজ যেসব লোককে বিভিন্ন বংশ বা গোত্রের প্রতিষ্ঠাতা বা 'প্রথম পুরুষ' বলে মনে করা হয়, তাদের সকলেরই পূর্ব পুরুষ উর্দ্ধদিকে কোথাও না কোথাও এক ছিল এবং শেষ পর্যন্ত এ সকলকেই একই মূল সূত্র থেকে উদ্ভূত বলে স্বীকার করতে হবে। তাহলে 'আর্য' ও 'অনার্য' নামে মানুষের মধ্যে এ বিভেদ কিরূপে স্বীকার করা যেতে পারে?

বর্ণবৈষম্যঃ

মানব সমাজে বর্ণবৈষম্য সর্বাপেক্ষা অধিক কদর্য ও অর্থহীন ব্যাপার। বর্ণ কেবল দেহের একটি বাহ্যিক গুণমাত্র; কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, মানুষ মনুষত্বের মর্যাদা তার দেহের জন্য লাভ করেনি, তার আত্মা ও মানবিকতাই হচ্ছে এ মর্যাদা লাভের একমাত্র কারণ। অথচ এর রঙ বা বর্ণ বলতে কিছু নেই। এমতাবস্থায় মানুষের মধ্যে লাল, হলুদ, কৃষ্ণ ও শ্বেত প্রভৃতি বর্ণের দিক দিয়ে পার্থক্য করার কি যুক্তি থাকতে পারে? কৃষ্ণ বর্ণের গাভী ও শ্বেত বর্ণের গাভীর দুধের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা যায় না। কারণ দুধই সেখানে মুখ্য, সেখানে রক্ত বা বর্ণের কোনোই গুরুত্ব নেই। কিন্তু মানুষের দেউলিয়া বুদ্ধি আজ মানুষের আভ্যন্তরীণ গুণ-গরিমা থেকে তার দেহাবরণের বর্ণের দিকে আমাদেরকে আকৃষ্ট করেছে। এটা অপেক্ষা মর্মান্তিক দুরবস্থা আর কি হতে পারে?

স্বদেশিকতাঃ

স্বদেশিকতার ঐক্য গোত্রবাদ অপেক্ষাও অস্পষ্ট ও অমূলক। যে স্থানে মানুষের জন্ম হয়, তার পরিধি এক বর্গ গজের অধিক নিশ্চয় হয় না। এতোটুকু স্থানকে যদি সে নিজের স্বদেশ বলে মনে করে, তাহলে বোধ হয় সে কোনো দেশকেই নিজের স্বদেশ বলতে পারে না। কিন্তু সে এ ক্ষুদ্রতম স্থানের চর্তুদিকে শত-সহস্র মাইল ব্যাপী সীমা নির্ধারণ করে ও এ সীমান্তবর্তী স্থানকে সে 'স্বদেশ' বলে অভিহিত করে এবং উক্ত সীমারেখা বর্হিভূত এলাকা র সাথে তার কোনোই সম্পর্ক নেই বলে অকুন্ঠিতভাবে প্রকাশ করে। মূলত এটা তার একমাত্র দৃষ্টিসংকীর্ণতা ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্যকথায় গোটা পৃথিবীকে তারা নিজের বলে অভিহিত করতে কোনোই বাঁধা ছিলো না। এক 'বর্গগজ' পরিমিত স্থানের 'স্বদেশ' যে যুক্তির বলে সম্প্রসারিত হয়ে শত-সহস্র বর্গমাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে, ঠিক সেই যুক্তিতেই তা আরো অধিকতর বিস্তার লাভ করে নিখিল বিশ্ব তার স্বদেশে পরিণত হতে পারে।

নিজের দৃষ্টিকোণ সংকীর্ণ না করলে মানুষ স্পষ্টভাবে দেখতে পারে যে, নদী-সমুদ্র, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি যা কিছুকেই কাল্পনিকভাবে সীমারেখা হিসাবে ধরে নিয়ে একটি এলাকাকে অপর একটি এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখে, প্রকৃতপক্ষে তা একই বিশাল পৃথিবীর অংশবিশেষ; কাজেই এ পাহাড়-পর্বত ও নদী-সমুদ্র তাকে সীমাবদ্ধ একটি এলাকায় কিরূপে বন্দী করে দিতে পারে? সে নিজেকে সমগ্র পৃথিবীর অধিবাসী বলে মনে করে না? সারা দুনিয়াকে সে তার 'স্বদেশ' বা জন্মভূমি বলে মনে করলে সে নিজেকে গোটা ভূপৃষ্ঠের অধিবাসী বলে কেন মনে করে না? সারা দুনিয়াকে সে তার স্বদেশ বা জন্মভূমি বলে মনে করলে আর ভূ-পৃষ্ঠের অধিবাসী সমগ্র মনুষ্যজাতিকে 'স্বদেশবাসী' বলে অভিহিত করলে এবং ভূমিষ্ঠ হওয়ার নির্দিষ্ট স্থানটুকুতে তার যে অধিকার আছে, সমগ্র বিশ্বজগতের উপরও সেই অধিকার দাবী করলে তা ভুল হবে কেন?

:: সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী ::